Kanon - Details
← সব বই দেখুন
Kanon
Kanon
লেখক: Watery Sky
ক্যাটাগরি: Literature
আপলোড তারিখ: July 19, 2025, 5:13 pm

বইয়ের কন্টেন্ট

জানালার পাশের ইজি চেয়ারে বসে এক দৃষ্টে বাইরে তাকিয়ে আছে কানন।রাত তিনটা বাজে কিন্তু কাননের চোখে ঘুম নেই।কাল থেকে তার কলেজ জীবন শুরু। অরিয়েন্টেশন হয়ে গেছে কাল থেকে ক্লাস শুরু হবে।
অন্তত পক্ষে ক্লাসে যাওয়ার জন্য হলেও তার কী উচিত না এখন ঘুমানো?
পাশের টেবিলে থাকা ফোনটা তুলে নিলো সে।হোয়াস অ্যাপে ঢুকে দেখলো রিয়াদকে দেয়া মেসেজ সেন্ট হয়েছে কিনা।না হয় নি।রিয়াদ নিশ্চয়ই ঘুমাচ্ছে ভাবলো কানন।

রিয়াদ তার ছোট বেলার বন্ধু সেই বন্ধুত্ব এখন প্রণয়ে পরিণত হয়েছে। তারা একই কলেজ এ ভর্তি হয়েছে।কাননের এসএসসিতে যে নম্বর ছিলো তাতে সে দেশের সর্বোচ্চ কলেজেই ভর্তি হতে পারতো কিন্তু রিয়াদের সাথে একই কলেজে পড়বে বলে অন্য কলেজে ভর্তি হলো।
এটা কি সঠিক সিন্ধান্ত ছিলো?
এসব কি আজে বাজে ভাবছে সে!
ঘুমাতে হবে তো!চেয়ার থেকে উঠে বিছানায় গেলো রুমের আলো আগে থেকেই অফ কিন্তু ড্রয়িং রুমের লাইট অন করা তাই তার রুমও কিছুটা আলোকিত হয়ে আছে। নিশ্চয়ই তার বাবা আজ আবার ড্রয়িং রুমে ঘুমাবে।তার উচিত তার বাবার সাথে কথা বলা,আবার কি সমস্যা হয়েছে সেটা অন্তত পক্ষে একবার জিজ্ঞেস করা।
কিন্তু সব সময় এতো উচিত কাজ করতে ইচ্ছে করে না।
বিছানায় সোয়ার পরও ঘুম আসছে না। কিছুক্ষণ শোয়ে থাকার পর উঠে বই নিয়ে বসলো কানন।ফ্রান্স কাফকার মেটামরফোসিস ।পড়তে পড়তে কখন ঘুমিয়ে পড়লো সে তা তার জানা নেই।
ঘুম ভাঙলো আমিনার ডাকে।আমিনা কাজ করে কাননদের বাসায়।ফ্রেশ হয়ে নাস্তার টেবিলে গিয়ে দেখলো কেউ নেই, আমিনা এসে নাস্তা রেখে গেলো টেবিলে।
টেবিলে নানা রকম ফল,ব্রেড,জেল কিন্তু কিছুই খেলো না কানন।কফি চাইলো আমিনার কাছে।তার মা হসপিটালে চলে গেছে আর বাবাও নিশ্চয়ই ফ্যাক্টরিতে চলে গেছে।আজকের দিনটা অন্তত সে তার বাবা,মার সাথে নাস্তা করতে চেয়েছিলো।
কফি বানিয়ে আনলে কফিটা হাতে নিয়ে রুমে চলে গেলো।
কফিটা টেবিলের উপর রেখে রেডি হয়ে চলে গেলো কলেজে।আজ প্রথম দিন বলে কলেজ শুরু দশটায়।সে কলেজে ঢুকেই ঘড়ির দিকে তাকালো।দেখলো ঘড়িটা উলটো পড়েছে।ঘড়িটা ঠিক করে পড়ে আবার তাকালো ঘড়ির দিকে দেখলো নয়টা পঞ্চাশ বাজে।
রিয়াদকে দেখতে পেলো কিছু ছেলের সাথে দাঁড়িয়ে আছে।তাকে দেখে কাছে এলো রিয়াদ।টুকটাক কথা হলো তাদের মধ্যে তারপর শুরু হলো ক্লাস।
কাননকে দেখে যে কেউ তার প্রতি আকৃষ্ট হবে এমন ভাবেই সে নিজেকে প্রেজেন্ট করে সচরাচর কিন্তু কেমন জানি এবার সেটা হচ্ছে না সে ক্লাসে এটেন্ড করতে পারছে না ঠিক মতো।কারো সাথে মিশছেও না তেমন।কেউই যে তাকে নোটিশ করে নি ব্যাপারটা এমনও নয়।অনেকেই নোটিশ করেছে আর নোটিশ করার কারণটাও জানে কানন।সে কলেজে গাড়ি নিয়ে এসেছে এটাই সেই কারণ।তাকে কিছু মেয়ে গাড়ি থেকে নামতে না দেখলে যে তার দিকে কেউ ফিরেও তাকাতো না কেউ তা খুব ভালোই বুঝতে পারছে সে।কেমন যেনো তার ভালো লাগলো না কলেজটা এমনকি মানুষগুলো কেউ ভালো লাগলো না তার।
বেশ কিছুদিন হয়ে গেলেও তার কোনো বন্ধু বান্ধব হলো না।তবে প্রথম দিনের সেই ইম্প্রেশন চেইঞ্জ হয়েছে এই কলেজের এক জনকে তার ভালো লেগেছে।উনি হলো হায়ার ম্যাথের মেরি ম্যাডাম।ম্যাডামের চেহারাটাতেই এতো মায়া লাগানো!তবে কারো চেহারার মায়া দেখে তাকে ভালো লাগার মতো মন কাননের নয়।ভালো লাগার কারণ হলো মেরি ম্যাডাম জানেন কানন মি: আজিজের মেয়ে তা সত্ত্বেও কাননকে আলাদাভাবে দেখেন নি।তার দৃষ্টিতে সব স্টুডেন্টই সমান।
না ভুল বললো কানন।সবাই সমান না বরং যারা দূর্বল তাদের প্রতি যেনো উনি একটু বেশি সহানুভূতিশীল।একজন শিক্ষকের তো এমনই হওয়া উচিত।তাই না?
তবে এদিকে রিয়াদের অনেক বন্ধু বান্ধব হয়ে গেছে।এক দিন তারা সবাই মিলে রেস্টুরেন্টে খেতে গেলো কানন কেও ইনভাইট করেছিলো রিয়াদ কিন্তু সে যায় নি।
তার এখন এসব আর ভালো লাগে না।মেরি ম্যাডামের ক্লাস ছাড়া কলেজে তার আর কিছু একদমই ভালো লাগে না।সেদিন রসায়ন ক্লাসে একদমই মন বসছিলো না।বের হয়ে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে। ক্লাসে স্যার পড়াচ্ছে এমন সময় সে দাঁড়িয়ে বললো,'স্যার আমার খুব পেটে ব্যাথা করছে। একটু ওয়াশরুমে যেতে পারি?'
'হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। '
একটু পর ক্লাসে ফিরে এসে বললো,'স্যার আমার খুবই খারাপ লাগছে। আমি কি বাসায় যেতে পারবো?'
'তোমার বাসায় কল দিতে হবে।এভাবে তো ছাড়া যাবে না।'
অফিসের এক ক্লার্ক তাদের বাসার টেলিফোনে বেশ কয়েকবার ট্রাই করলো কেউ তুললো না।তারপর সেই ক্লার্কই তাকে রিকশায় তুলে দিলো।
কিছুক্ষণ পর কানন রিকশাওয়ালাকে বললো,'মামা আপনি আমাকে এই ঢাকা শহরটা ঘুরে দেখাতে পারেন?'
'কেন পারুম না।অবশ্যই পারুম,তয় আফা ভারা তো মেলা অইয়া যাবো।'
'যা ভারা হয় দেবো আমি।আপনি আমাকে নিয়ে ঘুরুন সন্ধ্যা পর্যন্ত।'
কিছুক্ষণ পর কি হলো বললো,'মামা আপনি 'সানশাইন ' হাসপাতালে নিয়ে চলুন আমাকে।'
এটা তার বাবারই হসপিটাল। তার মাই দেখা শোনা করে,তার মা,মিসেস মেরি এখান কার ডাক্তার।সেখানে পৌছে তার মার সাথে দেখা করলো না সে বরং নাজমা নামক কোনো খালার খোঁজ করতে লাগলো।তাকে খুজে বের করে অনেকক্ষণ নানা কথা বললো নানাজিজ্ঞাসাবাদ করলো।যেমন উত্তর পাবে বলে ভেবেছিলো তেমন উত্তরই পেলো।
বাসায় ফিরে এসেই দরজা বন্ধ করে দিলো,দুপুরের
খাবারও খেলো না।সারাবিকেল বিছানায় শুয়ে বালিশে মুখ গুজে কান্না করলো।নিজেকে আর ভালো লাগে না তার।বেশিক্ষণ কান্না করলে কাননের মাথা ব্যাথা করে আজও তার ব্যাতিক্রম হলো না।কান্না থামিয়ে উঠে বসলো, কিছুক্ষণ পর ওয়াশরুমে গেলো গোসল করতে। ঠিক কতোক্ষণ যে সে বাথটাবে ডুবে ছিলো জানা নেই তার।গোসল করতে তার প্রচন্ড ভালো লাগে।না ঠিক ভালো লাগে বলা ঠিক হবে না, বলা উচিত তার যখন মন খারাপ থাকে সেই মন খারাপ আরো গাঢ় করতে সে পানির সংস্পর্শে যায়।আচ্ছা মানুষ কি দুঃখতেও সুখ পায়?নাহয় কেনো কারো মন ভেঙে গেলে সে কেনো এমন গান শুনে যাতে তার মন দ্বিগুণ খারাপ হয়?মানু্‌ষের দুঃখের ধরণ অনেক আর সব আলাদা আলাদা আর সেই দুঃখকে নিজের জন্য জ্বলন্ত উনুন বাড়ানোর পদ্ধতিও আলাদা।
গোসল শেষে আবার এসে শুয়ে রইলো কানন।বিছানার এক প্রান্তে শুয়ে আছে সে, চুল গুলো ছেড়ে দেয়া,সেগুলো ফ্লোর ছুয়েছে,ফ্লোরেও ধীরে ধীরে পানি জমছে। আর সে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ফ্যানের দিকে।এই নিস্তব্ধতাকে রাঙিয়ে দিচ্ছে তার চুলের মিষ্টি গন্ধ।
কলেজের বেতন দেয়ার শেষ দিন আজ কিন্তু তার বাবা বা মা কাউকেই বলতে মনে নেই তার।তারা কেউ এখন বাসায়ও নেই।বাবাকে কল দিলে সে কাননকে আলমারি থেকে টাকা নিয়ে যেতে বললো।
কানন তার বাবার রুমে গিয়ে আলমারি খুলে টাকা বের করে নিলো। তারপর আলমারি লাগানোর পর দেখলো একটি কাগজ নিচে পরে আছে।কাগজটিতে কি হিবিজিবি লেখা!হয়তো কোনো কিছুর ফর্মুলা।তাদের তো কতো কিছুর ফেক্টরি।ঔষধ ফ্যাক্টরির বা হয়তো এয়ারফ্রেশনার ফ্যাক্টরির নতুন কোনো ফর্মুলা।লেখা দেখেই বুঝা যাচ্ছে রিসেন্টলি লেখা হয়েছে তবে এর বিশেষত্ব হচ্ছে লেখাগুলো লাল কালিতে লেখা।কিন্তু কাগজটি ছিলো কোথায়?কোথা থেকে নিচে পড়লো?হয়তো আলমারিতে ছিলো। আলমারি খুলে কাগজটি আলমারির ড্রয়ারে তুলে রাখলো সে।
সেদিন সন্ধায় কানন ছাদে গেলো ফুল গাছে পানি দিতে
সে মাঝে মাঝেই ফুল গাছে পানি দেয়।নানা রকম মৌমাছি, প্রজাপতি জায়গা টাকে ভরে রেখেছে।
সে নিজে নিজেই বললো,'আমি যদি একটি প্রজাপতি ধরতে পারি তাহলে বাবা,মার ডিভোর্স হবে না।'
অনেকেক্ষন চেষ্টার পর অবশেষে একটি প্রজাপতি ধরতে পারলো সে।বাচ্চাদের মতো খুশি হয়ে গেলো কানন।পরমূহুর্তেই তার কাছে ব্যাপারটাকে বোকামি বলে মনে হলো।সে এই ব্যাপারটাকে বিশ্বাস না করলেও দিনে অন্তত চার-পাচ বার এই কাজটা করে।সে চায় না তার বাবা,মা আলাদা হোক আর এটাই তো হওয়া উচিত।পৃথিবীর কোনো সন্তানই চায় না তার বাবা,মা আলাদা হোক আর তাকে বেছে নিতে হোক যে কোনো একজনকে।কিন্তু কানন কি চায় তাতে তো তার বাবা,মা চলে না।
তার বাবা,মা প্রায়ই ঝগড়া করে,মাঝে মাঝেই তার বাবা বাড়ি ফেরে না,শেষ কবে তারা তিন জন এক সাথে খাবার টেবিলে এক সাথে খেয়েছে মনে পড়ে না তার।তার বাবা,মার জীবনে কি শুধু তাদের ব্যাক্তিগত জীবনই গুরুত্বপূর্ণ? কাননের কথা কি তারা এক বারো ভাবে না?কত রাত কাটে কাননের নির্ঘুম,কত রাত না খেয়েই কেটে যায় তারা কি জানে সেসব?জানে না তো।জানতে চায়ও না। তারা নিজেদের সমস্যা নিয়েই ব্যাস্ত।
আচ্ছা কানন কেনো নিজেকে নিজে হারিয়ে ফেলছে?সে পড়ালেখায় অনেক ভালো ছিলো কিন্তু এখন খুবই খারাপ করছে।স্কুলে থাকাকালীন সবসময় সে প্রথম হতো সে সবসময় রিয়াদের পড়ালেখায় সাহায্য করতো কিন্তু এখন সে নিজেকেই সাহায্য করতে পারছে না।এখন তাদের কলেজের ফার্স্ট গার্ল হলো উদিতা।রিয়াদের খুব ভালো বন্ধু, সমসময় তারা ডিসকাস করে পড়ালেখা করে।
শুধু পড়ালেখা হচ্ছে না কাননের।
গত এক সপ্তাহ যাবৎ কানন কলেজে যায় না।কলেজে গেলে দমবন্ধ লাগে তার।আবার বাসায়ও একা একা ভালো লাগে না।বিকেলে সে কল দিলো রিয়াদকে।
'ফ্রী আছিস?'
'কেনো?'
'চল আজকে একটু বের হই আমার বাসায় বসে দমবন্ধ লাগছে।'
'কলেজে আসিস না কেনো?'
'ভালো লাগে না তাই যাই না।তুই কি যাবি আমার সাথে?'
'আমি যদি এখন না বলি?'
'তুই না গেলে আমি একাই যাবো।'
'কখন বের হবি?'
'এইতো একটু পরেই। সাড়ে চারটার দিকে।'
'ঠিক আছে আসছি আমি।'
'ফ্লাওয়ার ভিলা তে যাবি।'
নাম ফ্লাওয়ার ভিলা হলেও এটা আসলে একটা কফি শপ।ফুলে ঘেরা খুব সুন্দর একটা কফি শপ।বাইরে থেকে দেখলে মনেই হবে না যে এটা একটা কফি শপ হতে পারে। মনে হয় যেন বিশাল একটা বাগান তার মাঝে ছোট্ট ছোট্ট কিছু ঘর।এই কফি শপটা শহরের বাইরে শহরের মানুষ এটার খোজ খুব একটা জানে না।তাই ভিড়ও তেমন থাকে না।কানন মাঝে মাঝেই গাড়ি নিয়ে একাই বেরিয়ে পরে।তেমনই এক দিনে এ জায়গাটা খুজে পায়। জায়গাটা খুবই পছন্দ তার।কাউকে এ জায়গায় খবর দেয় নি, শুধু রিয়াদের সাথে এখানে আসে কানন।
রেডি হতে গেলো কানন।তার সবচেয়ে পছন্দের সাদা রঙের জামাটা পড়লো কিন্তু কেমন যেনো মানাচ্ছে না তাকে জামাটায়।তার গায়ের রঙ বেশ কালো লাগছে আগের তুলনায়। ভালো ভাবে আয়নাতে দেখলো নিজেকে আজ। একি অবস্থা তার!চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল,মুখ ভর্তি বর্ন,মুখটা দেখতে বেশ কালো কালো লাগছে।তার কি উচিত মেকাপ করে যাওয়া?
কানন সচরাচর মেকাপ করে না এমনকি তার মেকাপ করতে ভালোও লাগে না।তাছাড়া তার দরকারও হয় না মেকাপের সে এমনিতেই অনেক সুন্দর। তাহলে আজ কেনো এমন লাগছে তাকে দেখতে?রাতে ঘুম হচ্ছে না,খাওয়া,দাওয়া হচ্ছে না তাই?সে যাই হোক মেকাপ করবে না বলে সিদ্ধান্ত নিলো,পরিয়াদ তো তাকে আজ প্রথম দেখছে না আর তাছাড়া সে এখন দেখতে যেমন রিয়াদের উচিত তাকে সেভাবেই মেনে নেয়া।
ঠিক সাড়ে চারটায় পৌছালো কানন।রিয়াদ তখনও পৌছায় নি।এটা নতুন কিছু নয়। এটাই এখন স্বাভাবিক হয়ে গেছে যে কানন ঠিক সময়ে পৌছাবে সব জায়গায় আর রিয়াদ পৌছাবে দশ পনের মিনিট দেড়িতে।আজকেও তাই হলো রিয়াদ যখন পৌছালো হাতে থাকা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো কানন চারটা চুয়াল্লিশ বাজে।
তারা কফি অর্ডার করলো।কানন বলে উঠলো,'আচ্ছা রিয়াদ তুই আমাকে ছেড়ে কখনো চলে যাবি না তো?'
'ধুর বোকা এসব কেমন কথা?'
'আমার খুব ভয় লাগছে।মনে হচ্ছে খুব শীঘ্রই আমি খুব একা হয়ে যাবো।'
'তুই কখনোই একা হবি না,আমি আছি তো তোর সাথে।'এ কথা বলে রিয়াদ কাননের খুব কাছে এসে বসে তার হাত চেপে ধরলো।
'কি হয়েছে তোর?এমন কথা কেনো বলছিস?আর তোকে দেখতেও অসুস্থ লাগছে।ঠিক আছিস তুই?'
কাননের চোখে পানি চলে আসলো।তবু কেউ তো আছে তার জীবনে এটা জিজ্ঞেস করার 'ঠিক আছিস তো তুই?'
তার মন চাচ্ছে রিয়াদকে জড়িয়ে ধরে বলুক,'ঠিক নেই আমি।আমি ভালো নেই রিয়াদ।আমার প্রতিটা মূহুর্ত মরে যেতে ইচ্ছে করে।কেনো এমন হচ্ছে আমার সাথে আমি নিজেও জানি না!'
'হ্যা ঠিক আছি আমি।'উত্তর দিলো কানন।
'শোন রিয়াদ আমরা যখন বড় হয়ে যাবো,বিয়ে করবো আমরা এ শহর ছেড়ে চলে যাবো।অনেক দূরে কোথাও। ঠিক আছে?'
হেসে উঠলো রিয়াদ,'কানন আমরা এখনো কলেজের স্টুডেন্ট আর তুই কতো দূর ভেবে ফেলেছিস!'
কানন মনটা খারাপ করে বাড়ি ফিরে এলো।রিয়াদ কথাটা এভাবে হেসে উড়িয়ে কেনো দিলো?সে কি চায় না কানন সারাজীবন তার সাথে থাকুক?কান্না পাচ্ছে তার গাড়িতে ড্রাইভার থাকায় ভালো ভাবে কান্না করতে পারছে না।
বাড়ি ফিরে এসে মাথাটা আরেক দফা গরম হলো।রুমে ঢুকেই দেখলো তার রুমে বসে আছে এক ছেলে।এমন নয় যে সে কিছু করছে,কারণ ছাড়াই বসে আছে।
তাদের বাসার কাজের লোক মানে আমেনা গিয়েছে ছুটিতে। আর তার পরিবর্তে কাজে এসেছে অন্য একজন যার নাম মায়া। তাতেও সমস্যা নেই কাননের কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে মায়া সাথে নিয়ে এসেছে তার ছেলেকে।ছেলেটার বয়স কম যদিও। বয়স ১০-১২ এর বেশি হবে না।তাই হয়তো বুঝে না কখন কি করতে হবে।
সেদিন দুপুরে কানন সোফায় বসে টেলিভিশন দেখছিলো কোত্থোকে হঠাৎ ছেলেটা এসে তার পাশে বসে পড়লো।এ কেমন অভদ্রতা।ছেলেটা এই ধরনের কাজ মাঝে মাঝেই করে।কাননের রুমের দরজা খোলা পেলেই সে ঢুকে পড়ে তার রুমে।ঢুকে ঘুরে ঘুরে দেখে তার রুম। এসবের কোনো কিছুই তার পছন্দ না।ছেলেটার মুখে হাসি থাকেই। এতো কিসের হাসি?বুঝে পায় না কানন।
তবে কথা বলে খুবই কম।শুধুই তাকিয়ে থাকে মুখের দিকে। কাননের ছেলেটার উপর বিরক্ত হওয়ার এটা আরো বড় একটা কারণ।
কলেজে নিয়মিত যায় না কানন এখন আর।একদিন কলেজে গিয়ে দেখলো দুইদিন পর থেকেই ইয়ার চেঞ্জ পরীক্ষা। অথচ সে জানেই না,রিয়াদও তাকে জানায় নি।তার কোনো প্রস্তুতিই নেই পরীক্ষার।
মন খারাপ করে বাড়ি ফিরলো কানন।রুমে ঢুকতেই দেখলো সেই ছেলেটা তার রুমে,সে কাননের ডায়েরিটা হাতে নিয়ে আছে যেনো পড়ছে। নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না কানন।কাছে গিয়ে এক চড় বসালো তার গালে আর বললো 'বেরিয়ে যাও।'
ছেলেটি অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে যেনো বুঝেই উঠতে পারলো না কি হয়েছে বা তার অপরাধ কি।
কানন আবারো চিৎকার করে উঠলো 'বেরিয়ে যেতে বলেছি তোমাকে।'
ছেলেটি নিশব্দে বেরিয়ে গেলো। ছেলেটি রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই অপরাধ বোধ কাজ করলো কাননের। তার মনে হলো ছেলেটি এমন কোনো অপরাধ করেনি যে কারণে কানন তার গায়ে হাত তুলতে পারে।ছেলেটি হয়তো পড়তেই পারে না।সে হয়তো বুঝেই না ডায়েরি কি জিনিস সেখানে সুইসাইডের মতো কতো মারাত্মক মারাত্মক শব্দ থাকতে পারে।কাননের কি উচিত ছেলেটার কাছে গিয়ে সরি বলা?থাক সরি বলার দরকার নেই। ছেলেটা তার রুমে ঢুকে এটা তার এমনিতেই পছন্দ না।
পরদিন খুব সকালে ঘুম ভেঙে গেলো কাননের। ফ্রেশ হয়ে নিজেই এক কাপ চা বানিয়ে চা টা হাতে নিয়ে ছাদে গেলো সে।ছাদ থেকে নিচে তাকাতেই তার চোখে পড়লো এক অসাধারণ দৃশ্য।তাদের বাসার সেই ছেলেটি বাগানের ফুল গাছ গুলোতে পাইপ দিয়ে পানি দিচ্ছে তবে মজার ব্যাপার হলো মাঝে মাঝেই সে নিজেই নিজের গায়ে পানি ছিটাচ্ছে আর তার মুখে কি অমায়িক হাসি!দেখেই মন ভালো হয়ে যাওয়ার মতো।কাননের মনে হলো সেও যদি যোগ দিতে পারতো ছেলেটির সাথে!আচ্ছা সে তো চাইলেই পারে যোগ দিতে।পারে না কি?কে কি ভাবছে তাতে কি তার কিছু যাওয়া আসা উচিত?কেউ কি ভাবে সে কি ভাবছে?ভাবছে না তো।
নিচে নেমে চায়ের কাপটা রান্না ঘরে রেখে বাগানে গেলো কানন।তখনো ছেলেটা আপন মনেই খেলছিলো পানি দিয়ে।কাননকে দেখেতেই থেমে গেলো সে।চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। পাইপ দিয়ে পানি পড়তেই রইলো নিচে।কানন হাত বাড়িয়ে পাইপটা নিলো আর পইপের মাঝ বরাবর আঙুল ঢুকিয়ে দিলো, ছিটকে উঠা পানি দিয়ে ভরিয়ে দিলো ছেলেটিকে। হেসে উঠলো ছেলেটি।সাথে সাথে দৌড়ে গিয়ে মগে করে পানি নিয়ে এসে সেও ভিজিয়ে দিলো কাননকে।
তাদের সাথে সাথে আশে পাশে থাকা ফুল গাছ গুলোও গোছল করে ফেললো ।গাছ গুলো হয়তো এই পানিকে বৃষ্টির পানি বলে ভুল করেছিলো।
এই নকল বৃষ্টি গাছগুলো কতটুকু উপভোগ করেছিলো তাতো জানা নেই তবে এই বৃষ্টিই ছিলো নতুন অনন্য এক বন্ধুত্বের সূত্রপাত। উনিশ বছরের এক মেয়ের সাথে দশ বছর বয়সি এক ছেলের বন্ধুত্বের সাক্ষী ছিলো এই গাছ আর নকল বৃষ্টি।
'আচ্ছা তোর নাম কি রে?'
'আফা আমার নাম ফটিক।'
'কোন ক্লাসে পড়িস তুই?'
'হেহে'
'কিরে হাসছিস যে।'
'আপা আমি তো পড়াশোনা করি না।'
কানন দুই মিনিট চুপ করে থেকে বললো -'আজ থেকে প্রতিদিন বিকেলে তুই আমার কাছে পড়তে আসবি।'
'আচ্ছা আপা।'
সেদিনই কলেজ থেকে ফেরার পথে কানন বই,খাতা থেকে শুরু করে পড়ালেখার সব কিছু কিনে আনলো।বাড়ি ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে গেলো তার।রুমে ঢুকেই দেখলো ফটিক তার রুমে পড়ার চেয়ার, টেবিলে বসে আছে।রাগ করতে গিয়েও কিছু বললো না সে।শুধু বললো -'তুই এখানে?'
'আপা আপনেই তো আসতে বলছিলেন। '
'যাও এক ঘন্টা পরে এসো আর আমার খাবারটা রুমে দিয়ে যেতে বলো তো কাউকে।'
'আচ্ছা আপা।'
গোসল করে এসে খেতে বসলো সে।ফ্লোরে বসে খাটের উপর প্লেট রেখে সামনে রাখলো ল্যাপটপ আর ল্যাপটপে চলছে 'মানি হেইস্ট'।এই খেতে বসার পদ্ধতিটা তার অন্যতম পছন্দের পদ্ধতি। যখন তার মন ভালো থাকে তখন সে এভাবেই খায়।খেতে খেতে কখন ৫:৩০ বেজে গেলো সে টেরই পেলো না।খাওয়া শেষ করে পেছনে ফিরতেই দেখলো ফটিক তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে।তাকে আচমকা এভাবে দেখে সামান্য ভয় পেয়ে গেলো কানন। তারপরই সামান্য হেসে বললো,'বস তুই আমি হাত ধুয়ে আসছি।'
কানন ফটিককে পড়াতে পড়াতে লক্ষ্য করলো ছেলেটার পড়ালেখার প্রতি প্রচন্ড আগ্রহ। এমন একটা ছেলেকে তার বাবা,মা কোন অবস্থায় পরে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে দেয় বুঝে পায় না সে!
ছেলেটা বেশ দ্রুতই পড়া বুঝতে পারে।তাকে পড়িয়ে বেশ মজা পেলো কানন তবে সামান্য লজ্জাও হলো নিজের প্রতি কারণটা হলো একটা ছোট্ট ছেলে যে কিনা পড়ালেখার কোনো সুযোগ পাচ্ছে না তবুও তার কিনা কতো আগ্রহ আর কাননের এতো সুযোগ থাকার পরেও সে পড়ালখা করছে না।তার কারণ কী?তার বাবা,মার ঝগড়া, বয়ফ্রেন্ড এর সাথে তার ঝগড়া।এগুলোও কোনো কারণ হতে পারে?নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করে সে।অন্য দিকে ফটিকের বাবা তাকে আর তার মাকে ফেলে চলে গেছে যখন তার বয়স দুই তখনই।ফটিকের মনেও নেই তার বাবা দেখতে কেমন।তার বাবার প্রতি তার একটাই প্রত্যাশা যেন তার বাবা একটি বার তাকে দেখতে আসে কারণ ফটিক জানতে চায় সে কার মতো হয়েছে,তার বাবার মতো নাকি তার মার মতো?
কি সামান্য এক চাওয়া।অন্যদিকে তার মা তাকে অভাবের কারণে স্কুলেও পড়াতে পারের না। কাননের এই বিলাশবহুল জীবন,বাড়ির বাইরে পাওয়া প্রাধান্য সবই সে পেয়েছে তার বাবা,মার করা সব অর্জনের জন্যেই।তবুও সে তার বাবা,মাকে পছন্দ করে না, তার মনে হয় তার মা,বাবা বড় বেশি সেলফিস।সেলফিস আসলে কে?তার মা,বাবা নাকি সে নিজেই?আবারো প্রশ্ন করে কানন নিজেকে।সে তো এক বারো বুঝতে চায় নি তার বাবা,মার সমস্যা কি, সে শুধুই ভেবেছে তাদের আচরণে তার নিজের কি কি সমস্যা হচ্ছে।আদর্শ পিতা-মাতার যেমন একটা সংগা হয় নিশ্চয়ই আদর্শ সন্তানেরও একটা সংগা হয়।তারও উচিত সেই সংগা মেনে চলা।কতো দিন হয়েছে সে তার বাবার মার রুমে যায় না?তার বাবা,মা কেমন আছে, তাদের ভালো মন্দ সে জিজ্ঞেস করে না?দুমাস?ছয় মাস?ঠিক কতো দিন হয়েছে মনেই করতে পারছে না কানন আজ সন্ধ্যাতেই পড়তে বসলো। অনেক সময় পড়লো আজ সে।রাতের খাবারের সময়ও তার বাবা,মা কেউ বাসায় ফেরে নি।রাত তখন একটা বাজে সে দেখলো তার মায়ের ঘরে আলো জ্বলছে উনি কখন ফিরেছে বাসায় জানে না কানন।মায়ের ঘরে ঢুকলো কানন। সে বিছানায় বসে ল্যাপটপ এ কোনো একটা কাজ করছিলো।হঠাৎ করে কাননকে দেখে অবাক হয়ে তাকালো। তারপরই নিজেকে সামলে নিয়ে বললো-'কেমন আছো কানন?'
'ভালো আছি।'
'সরি মা তোমাকে সময়ই দেয়া হচ্ছে না।একটু বসো তো আমার কাছে।'
কানন বসলো মায়ের পাশে।তার খুব ইচ্ছে করছে মাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে।কিন্তু কেনো?কান্না করার মতো কিছু তো হয় নি।সে কি জড়িয়ে ধরবে মাকে?
এমন সময় ফোন বেজে উঠলো মিসেস বেলির মানে কাননের মায়ের।উনি একবার ফোনের দিকে তাকালো তারপর কাননের দিকে।উনি ফোন তুললেন না।কিন্তু কানন জানে এতো রাতে কে তার মাকে কল করেছে।
কানন তার মাকে বললো,'তুমি কথা বলো। আমি পরে এক সময় আসবো।'
'না আমি তুমি বসো।এখন তোমার সাথে আমি কিছুক্ষণ গল্প করতে চাই।'
'কিন্তু আমি চাই না।'-বলে বেরিয়ে এলো কানন।
ছাদে চলে গেলো কানন।আকাশে বিশাল এক চাঁদ। ছাদটাও চমৎকার ভাবে সাজানো ফুল গাছ দিয়ে।তার মায়ের ফুল গাছ খুব পছন্দ। সেই সাজিয়েছে এই ছাদ।এই বাগানের কোনো একটি ফুলও কেউ ছিড়লে উনি সহ্য করতে পারতেন না।এই বাড়ির প্রতিটি কোনা উনি নিজের হাতে সাজিয়েছেন,নিজের হাতে তৈরি করেছেন এই বাড়িসহ সমস্ত কিছু।কিন্তু এখন উনি এখন কিভাবে সেই সব কিছু নিজের হাতে নষ্ট করছেন?কাননের বাবা,মা বিয়ে করেছিলেন তাদের পরিবারের অমতে। বিয়ের ১৫ বছর পর্যন্ত কোনো যোগাযোগ ছিলো না পরিবারের সাথে। তারা নিজেদের আকড়ে ধরেই বেচে ছিলো নিজেদের মধ্যে থাকা ভালোবাসা নিয়ে।আচ্ছা ভালোবাসা কি শক্তির সংরক্ষণশীলতার নীতি মেনে চলে?
'পৃথিবীতে ভালোবাসার পরিমাণ নিদ্রিষ্ট শুধু মাত্র এটি এক মানুষ থেকে অন্য মানুষে স্থানান্তর করে।এর সৃষ্টি বা ধ্বংস নেই।'-সূত্রটা কি এমন হবে?
কিছু কিছু মানুষের ক্ষেত্রে হয়তো সূত্রটা ব্যাতিক্রম। তাদের ভালোবাসা এক মানুষেই সীমাবদ্ধ থাকে সারাজীবন, স্থানান্তরিত হয় না।যেমন তার বাবা তার মাকে প্রচন্ড ভালোবাসে এটা জেনেও যে তার মা অন্য কাউকে ভালোবাসে।কাননের মা তার বাবার কাছে ডিভোর্স চায়।কিন্তু তার বাবা তাতে রাজি নয়।সে চায় যে কোনো মূল্যেই হোক মিসেস বেলি তার সাথেই থাক।তার বাবা যে কি প্রচন্ড কষ্ট পাচ্ছে সেটা বুঝতে পারে কানন...
কাননের এসব ভাবনায় ছেদ ঘটালো হাল্কা একটি পায়ের শব্দ। এ পায়ের শব্দ তো ফটিকের কিন্তু এতো রাতে সে ছাদে কি করবে?পেছন ফেরে তাকাতেই দেখলো ফটিক দাঁড়িয়ে আছে।অন্য সময় হলে বিরক্ত হতো কানন কিন্তু এখন কেমন যেনো বিরক্ত লাগলো না।চাদের আলোতে দেখেই বুঝতে পারলো কানন ফটিক কেবলি ঘুম থেকে উঠে এলো।
'কিরে এখানে কি করছিস তুই?'
'ঘুম ভাইংগা গেছিলো দেখলাম আপনার রুমে আলো আপনে ঘরে নাই।আপনারে খুজতে খুজতেই আইলাম এনে।'
'এসেই যখন পরেছিস বোস এখানে।'পাশে থাকা বেতের চেয়ার দেখালো তাকে।দুজনে মিলে বসলো সেখানে।
'চা খাবি ফটিক?'
'হ আপা খামু।'
কানন উঠে চলে গেলো ফিরে এলো দুই কাপ দুধ চা আর ড্রাই কেক নিয়ে।কেক আর একটা কাপ রাখলো টেবিলের উপর।ছাদের রেলিং এর সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছে কানন অন্যদিকে ফটিক চায়ের মধ্যে ড্রাই কেক ডুবিয়ে ডুবিয়ে খাচ্ছে। ফটিক ড্রাই কেকটা অনেকক্ষণ ডুবিয়ে রাখছে চায়ে তারপর খাচ্ছে মাঝে মাঝেই ডুবন্ত কেকটা উঠানোর সময় টপ করে পরে যাচ্ছে চায়ে।এই বিষয়টাই খুব মনযোগ দিয়ে দেখছে কানন।কানন ফটিককে জিজ্ঞেস করলো,'চা টা কেমন হয়েছে?'
'ভালা না।চিনি কম হইছে আফা।'
এমন সরাসরি উত্তরে একটু হতবাক হলো কানন।কিন্তু চিনি কেনো কম হবে?সে নিজেই তো চেক করলো চিনি তো কম হয়নি।হয়তো ফটিক চাতে আরো বেশি চিনি খেয়ে অভ্যস্ত।
'যা এখন তুই।ঘুমা গিয়ে।'
'আফা আপনে কি রাগ করলেন?'
'না তো।রাগ কেনো করবো?বরং খুশি হয়েছি।'
'খুশি কেনো হইলেন আফা?খুশি হওয়ার মতো তো কিছু করি নাই আমি।'
'করেছিস।এই যে তুই বললি চা টা ভালো হয়নি।এতেই আমি খুশি হয়েছি।তোর জায়গায় আমার বাবা থাকলে বলতো ' চা টা দারুণ হয়েছে মা।'
উনি একথা বলে চা টা উপভোগ করতে পারতেন না আর আমি সেটা বুঝতাম তার মুখ দেখে।তখন চা টা যতটা না খারাপ হয়েছে আমি তার চেয়েও খারাপ ভাবে উপস্থাপন করতাম নিজের কাছে।যেটা ঠিক না।আমরা সবসময় নিজেদের কাছে প্রশংসা প্রত্যাশা করি।নিজেদের নিয়ে গর্ব করতে পছন্দ করি।ঠিক তেমনি নিজেরাই যখন নিজেদের নিয়ে নিন্দা করি সেটা মেনে নেয়া কষ্টের হয়।
দেখ তুই কি সুন্দর বলে দিলি চিনি কম হয়েছে এরপর থেকে তোর চায়ে আমি চিনি বাড়িয়ে দিবো আর চা টা হবে পারফেক্ট।কিন্তু বাবার বেলায় তো আমি বুঝবই না চা টা কেনো ভালো হয় নি আর সেটা ঠিকও করতে পারবো না।তাই মিথ্যা প্রশংসার চেয়ে সরাসরি ভুলটা বলে দিলেই আমার ভালো লাগে।বুঝেছিস?'
'না আফা বুঝি নাই।বড়ই কঠিন কথা কইলেন।'
'কোনো কঠিন কথাই বলি নি।তুই যে জেগে আছিস কাল সকালে উঠতে পারবি?'
'না আফা কাইলকা উঠতে আমার দেরি হবো।ধরেন ১০ টা বাজবো।'
'এমন ভাবে বলছিস যেন তোর খুব রাত জাগার অভ্যাস! '
'না আফা সবসময় না।তয় যহন আমাগো গ্রামে ওয়াজ মাহফিল হয় আমরা প্রত্যেক বছর সারা রাত জাইগা ওয়াজ শুনতাম।কি যে আনন্দের দিন আফা ওই দিনটা।'
' কিন্তু এবার তো তুই শহরে যেতে পারবি না তো এ বছরের ওয়াজ মাহফিলে।'
'কি যে কন আফা।আমি ঠিকি যামু। দেইখেন আপনে।আফা আপনে গেছেন কোনো দিনো ওয়াজ মাহফিলে?'
'নাহ।'
'কি কন আফা!আফা এইবার যখন ওয়াজ মাহফিল হবো আমার সাথে আপনেও যাইয়েন।কি যে আনন্দের দিন আফা!না গেলে বুঝবেন না।ধরেন আমাগো গ্রামে যে ওয়াজ মাহফিল হয় ওইটা আমগো বাড়ি থেকে মেলা দূরে।সন্ধ্যা বেলাই আমরা সব রেডি হয়ে থাকি তারপরে খাওয়া দাওয়া শেষ করি।ধরেন আটটার দিকে সক্কলে আমাগো বাড়িতে আয় মানে আমার চাচি,চাচাতো ভাইবোনেরা।তারপর নয়টার দিকে আমরা সক্কলে মিলা রওনা দেই।আমার মা,চাচি,ফুপুরা থাকে এক সাথে আর আমরা ভাই,বোনেরা থাকি আরেক দলে।কত রকম খাবার যে থাকে আফা!আপনাগো শহরে এমন খাবার খুইজাও পাবেন না আর কতো কথা কয় ইমাম সাহেব!এগলা শহরের মানুষ শুনে না বইলাই শহরে এতো পাপ!'
এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কানন তার দিকে।যে ছেলেটা দুইদিন আগে তার সামনে একটি কথাও বলতে পারতো না আজ সেই ছেলে গড়গড় করে কতো কথা বলছে।আর সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো কাননের বিরক্ত লাগছে না এ সব শুনতে!

কাননের ইয়ার চেঞ্জ পরীক্ষা শেষ হয়েছে।একদমই ভালো হয় নি পরীক্ষাটা।নিজেকেই চিনতে পারছে না কানন!এই সেই কানন যে কিনা কোনো দিন দ্বিতীয় হয়নি কোনো কিছুতে?কাননদের স্কুলের যারা যারা এই কলেজে ভর্তি হয়েছে তারা অবাক দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে।সে দিন কথায় কথায় সৃজন বলে উঠলো,'কানন এতো পড়ালেখা করে কি করবে ওর বাবার তো অনেক টাকা।পড়ালেখা না করলেও টাকার জোরে বিদেশে চলে যেতে পারবে তাই পড়াশোনা নিয়ে কাননের কোনো চিন্তা নেই!'
কি স্বাভাবিক ভাবে সবাই নিজের নিজের মতামত জানিয়ে দেয়!সামনে থাকা মানুষটির সমর্থনেরও দরকার নেই তাদের।কেউ কখনো জিজ্ঞেস করলো না,'কানন কি হয়েছে তোর?কেনো পড়ালেখা হচ্ছে না?তুই ভালো আছিস তো?'
কানন সিদ্ধান্ত নিয়েছে যাই হোক না কেনো সে এখন থেকে মনে প্রাণে পড়ালেখা করবে।তার সব স্বপ্ন যে হারিয়ে যাচ্ছে!এটা কিভাবে হতে দিতে পারে সে!এই একটি জিনিস আঁকড়ে ধরেই যে বেচে আছে কানন!
পড়তে বসতেই এসে হাজির হলো কাননের এক আন্টি,সে কাননের মায়ের দূর সম্পর্কের বোন।
'কেমন আছো,মা?'
'ভালো।'
'তুমি এতো কালো হয়েছো কেনো?কেমন দেখাচ্ছে দেখো!নিজের যত্ন নাও না বুঝি একদম।শোনো বেশি বেশি ফল,মূল খাবে গায়ের রং উজ্জ্বল হবে।লেবু খাবে বেশি,ভিটামিন সি ত্বক উজ্জ্বল করে।'
'জ্বি খাবো।'
'তোমার মা ফেরে নি?তার সাথে কথা বলেতেই তো এলাম।'
'না মার ফিরতে রাত হবে।'
'কল দিয়ে আমার কথা বলো।এখনি আসতে বলো তাকে।'
'জ্বি।'
কানন বারান্দায় গিয়ে তার মাকে কল দিলেন।কল ধরলো না ওপাশ থেকে।তারপর একটু পরেই কল ব্যাক করলো উনি।ভদ্রমহিলাকে অপেক্ষা করতে বললেন।
মহিলা কাননের খাটের উপর বসে আবার কথা শুরু করলো।
'আমি একটা কথা শুনলাম।কথাটা কি সত্যি?' ভদ্রমহিলা যেনো আশা করছে এটুকু শুনেই কানন বুঝে ফেলবে উনি কি বলতে চাইছে।
'কি কথা?'
'তোমার বাবা,মার নাকি ডিভোর্স হচ্ছে?'প্রশ্ন করে উত্তর না শুনেই আবার বলা শুরু করলেন উনি,'তোমার মায়ের মাথাটা কি নষ্ট হয়ে গেছে?তোমার বাবার হাসপাতালের সামান্য এক ডাক্তারের সাথে তার সম্পর্ক! তেমন কেউ হলেও না হয় বুঝতাম!'
কানন কিছুই বলছে না মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।মহিলা একা একাই কথা বলে চলেছেন।'তোমার কি হবে এখন?তোমারই তো বিয়ের বয়স হয়ে গেছে।কোথায় তোমাকে বিয়ে দেয়া নিয়ে চিন্তা করবে।তা না!কোনো ভালো ফ্যামিলিতে এখন তোমাকে বিয়ে দিতে পারবে?'আমি...'
ফটিক তাড়াহুড়ো করে ঘরে ঢুকে বললো,'সর্বনাশ হইছে! ম্যাডাম আপনের ড্রাইভার গাড়ি নিয়া বাইর হইলো না?সে নাকি এক্সিডেন্ট করছে।'
'কি বলো তুমি এসব!হায় হায় আমার গাড়ি!'মহিলা ছুটে বেরিয়ে গেলেন।
বেরিয়ে যেতেই ফটিক হাসতে শুরু করলো।
'কি রে হাসছিস কেনো?তুই কি উনাকে মিথ্যে বলেছিস?'শান্ত কন্ঠে প্রশ্ন করলো কানন।
'হ'
'কেনো?'
'আমি বাইরে থিকা সবই শুনতেছিলাম।উনি আপনারে কি সব বলতাছিলো!'
'এতো বেশি বুঝিস কেনো?কেনো মিথ্যে বললি?তোকে আমি দায়িত্ব দিয়েছি কোনো যে যখন আমি বিপদে পড়বো আমাকে বাচাবি সেখান থেকে?'কড়া কন্ঠে বললো কানন।চুপ করে রইলো ফটিক।
'উনি যখন জানবে তুই মিথ্যা বলেছিস কিভাবে অপমান করবে তোকে তোর কোনো ধারণা আছে?যা বাইরে যা।গিয়ে রেডি হ।
'কেন আফা?'
'বেশি প্রশ্ন করবি না।যা করতে বলেছি তাই কর।'
একটু পর গাড়ি নিয়ে বের হলো কানন আর তার সাথে ফটিক।
'আমরা এখন একটি জায়গায় যাবো জায়গাটা আমার ভীষণ পছন্দ সেখানে গিয়ে আমরা কফি খাবো।দাড়া আজকে আমি তোকে একজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো।তাকেও কফি শপে যেতে বলি।আমরা কফি খাওয়ার পর রাতে বাইয়ে ডিনার করবো। তারপর তিনজন মিলে ঢাকার রাস্তায় হাটবো। বাসায় ফিরবো অনেক রাতে ততক্ষণে মিলি আন্টিও চলে যাবে।তোকে বকতেও পারবে না আর।কি রে রাজি তো?' একটু আগেও যে এই মেয়েরই তীব্র মন খারাপ ছিলো এখন তাকে দেখে তা বুঝার উপায় নেই।সে রিয়াদকে কল করলো।কিন্তু কল তুললো না রিয়াদ।আবারো কল করলে কেটে দিলো কল।আর কল করলো না কানন। তাদের মধ্যে কেউ কল কাটলে অপর জনকে বুঝে নিতে হবে যে চরম ব্যস্ততার কারণেই কল রিসিভ করছে না।
'আজ মনে হয় আমাদের পরিকল্পনা আমাদের দুজনকেই বাস্তবায়ন করতে হবে।আমার অতিথি সম্ভবত ব্যস্ত।'
সন্ধ্যা ছয়টার দিকে তারা গিয়ে পৌছালো ফ্লাওয়ার ভিলাতে।ফ্লাওয়ার ভিলার শেষের দিকটায় ছোট্ট একটা লেকের মতো আছে এখানে আসলেই কানন ওই লেকের পাশে গিয়ে বসে আজকেও সে দিকেই রওনা হলো।যেতে যেতে লক্ষ্য করল সে আর রিয়াদ যে জায়গায় বসে সচরাচর সেখানে বসে আছে একটি ছেলে আর একটি মেয়ে।আশ্চর্য হওয়ার মতো ব্যাপার হলো ছেলেটিকে দূর থেকে দেখতে অবিকল রিয়াদের মতো লাগছে।আরেকটু কাছে যেতেই সে লক্ষ্য করলো ছেলেটি রিয়াদই তার পাশে খুব সুন্দর একটি মেয়ে।মেয়েটি অন্য কেউ নয়, উদিতা।তারা খুব কাছাকাছি বসে আছে।তাদের দেখেই বুঝা যাচ্ছে তারা শুধু বন্ধু নয়,অন্য কিছু।
তারা নিজেদের মধ্যে এতোটাই বিভোর যে তারা খেয়ালই করছে না কাননকে।কানন নিঃশব্দে বেড়িয়ে এলো কফি শপ থেকে।ফটিক বুঝতে পারছে না কি হচ্ছে। গাড়িতে উঠতেই ফটিক প্রশ্ন করলো,'আফা আমরা কফি খামু না?'
'আজকে না ফটিক অন্য কোনো দিন।আমার খুব মাথা ধরেছে।'খুব ধীরে ক্ষীণ কন্ঠে বললো কানন।
রাস্তায় আর কোনো কথাই হলো না। বাসায় গিয়েই রুমের দরজা বন্ধ করে দিলো।
কাননের অভ্যাস বাইরে থেকেই বাড়ি ফিরেই গোসল করা আজও তার ব্যাতিক্রম হলো না।গায়ে থাকা ভারি জামা নিয়েই বাথটাবে শুয়ে পরলো কানন।সারা শরীর ডুবে আছে পানিতে এমনকি মুখও। একটু পর পরই পানি থেকে মুখ তুলে জোরে জোরে শ্বাস নিতে হচ্ছে তার।এভাবে সে ঠিক কতক্ষন ছিলো জানা নেই তার। সে নিজেকে আবিষ্কার করলো নিজের বিছানায়।চোখ খুলতেই দেখলো ফটিক তার পাশে বসে আছে।
' আলহামদুলিল্লাহ! আপনার জ্ঞান ফিরছে অবশেষে!কি যে চিন্তায় আছিলাম!'
ফটিকের কাছে জানতে পারলো দুইদিন পর আজকে তার জ্ঞান ফিরেছে,তীব্র জ্বরে এ দুদিন অচেতন হয়ে পড়ে ছিল সে।তার রুমের,বাথরুমের লক ভেঙে তাকে বের করা হয়েছে।তার জন্য ডাক্তার,নার্স বাড়িতেই আনা হয়েছে।তারাই সেবা শুশ্রূষা করছে কাননের। আশে পাশে তাকালো কানন।তার বাবা বা মা অন্তত একজনকে মনে মনে প্রত্যাশা করছিলো সে।কিন্তু নেই কেউই।
দুইদিন পর মোটামুটি সুস্থ হয়ে উঠলো কানন।রাতের বেলা কাননের বাবা এলেন তার রুমে।এসে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো কান্না করতে লাগলো।
'তোর কিসের এতো দুঃখ মা?তুই কেনো ঘুমের ঔষধ খেয়ে বাথটাবে ডুবে ছিলি?'
'আমার ঘুম হয় না বাবা,তাই ঘুমের ঔষধ খেয়েছিলাম।অন্য কোনো কারণে নয় তো।'
'এতোগুলো ঔষধ কেনো খেয়েছিলি মা?'
'কই বাবা আমি তো দুটু ঔষধ খেয়েছিলাম শুধু।'
'আমাকে কথা দে মা আর কখনো ঘুমের ঔষধ খাবি না।'
'আচ্ছা খাবো না।বাচ্চাদের মতো কান্না করো না আর।'
'তুই কিছু খাবি মা?বা কোথাও বেরাতে যাবি?'
'না,বাবা।'
'মা তুই আমার কাছে কিছু একটা চা।কতো দিন হয়ে গেছে তুই আমার কাছে কোনো আবদার করিস না!'
'বাবা চলো আমরা তিনজন আজকে রাতের খাবারটা এক সাথে একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাই।আমি,তুমি আর মা।
'নিশ্চয় মা।'আস্তে করে বললো সে।
'তুমি ভেবো না বাবা, মাকে আমি রাজি করাবো তোমাকে কিছু বলতে হবে না।'
'ঠিক আছে মা।'
কাননের কপালে চুমু দিয়ে চলে গেলো তার বাবা।তার বাবা অন্য সবার চেয়ে আলাদা।তাকে প্রচন্ড ভালোবাসে তার বাবা।অন্য বাবারা তাদের মেয়েদের এতোটা ভালোবাসে না।সব ভালোবাসার সম্পর্কে শাসন থাকে কিন্তু তার বাবার ভালোবাসায় কোনো শাসন নেই।শুধুই ভালোবাসা। অন্যদিকে তার মায়ের ভালোবাসা কেমন সেটা জানা নেই কাননের।ছোটবেলায় কখনো অসুস্থ হলে তার বাবা সারারাত জেগে বসে থাকতো অন্যদিকে তার মা ডাক্তারের ভূমিকা পালন করতো শুধু,মা হওয়ার ভূমিকা নয়।এবারও তাই হচ্ছে। জ্ঞান ফেরার পর থেকে মাত্র একবার দেখেছে সে তার মাকে।
ধীরে ধীরে উঠে মায়ের ঘরে গেলো কানন।কানন জানে তার মা বাইরে খেতে যেতে রাজি হবে না।বলবে সে ভীষন ব্যস্ত।কানন দরকার হলে করজোড়ে অনুরুধ করবে তার মাকে।সে এমন জীবন নিতে পারছে না আর এতো একাকিত্ব তাকে গ্রাস করছে ক্রমশই।
তার মায়ের রুমে ঢুকেই মিষ্টি একটা গন্ধ পেলো,হালকা বাদামের মতো গন্ধ,কিন্তু তবুও গন্ধটা খুব ভালো লাগছে। পুরো রুমটা অন্ধকার হয়ে আছে। বাইরে থেকে আসা হাল্কা আলোতে দেখতে পেলো তার মা শুয়ে আছে,হয়তো চোখ বন্ধ করা।দরজার কাছে দাড়িয়ে আস্তে করে ডাক দিলো কানন,'মা!'
চমকে উঠলো তার মা।তারপর কাননকে দেখে বললো,'আরে কানন এসো ভেতরে এসো।'
কানন ভেতরে গেলে উনি জিজ্ঞেস করলো,'তোমার শরীর এখন কেমন?'
'ভালো।'
'কিছু বলবে?'
'মা আজকে বাইরে খেতে যাবে?আমি,তুমি আর বাবা?'
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কাননকে অবাক করে দিয়ে উনি বললেন,'তুমি যখন চাইছো নিশ্চয়ই যাবো।'
'আমি তাহলে রেডি হয়ে আসি মা আর বাবা কেউ জানাই!'
প্রফুল্ল মুখে বেরিয়ে গেলো কানন।
খুব সুন্দর করে সাজলো আজ কানন।খুব সুন্দর লাগছে তাকে।রেস্টুরেন্টে যাওয়ার আগে ফটিককে অনেক গুলো পড়া আর বাড়ির কাজ দিয়ে গেলো কানন।নানা ঝামেলায় ফটিকের পড়ালেখাই হচ্ছে না।
তার বাবা,মাও খুব সুন্দর করে রেডি হয়েছে।কি সুন্দর লাগছে দুজনকে!
তারা তিনজন মিলে একটি চাইনিজ রেস্টুরেন্টে গেলো।খাবার অর্ডার দিলো,কিছুক্ষণের মধ্যে খাবার এসেও গেলো।
রেস্টুরেন্টটিতে একজন ক্যামেরাম্যান সব টেবিলে থাকা মানুষেরই ছবি উঠিয়ে দিচ্ছিলেন। তাদের টেবিলে এসে তাদেরও ছবি তুললেন।কানন আর তার মায়ের একটি ছবি তুলে দিলেন।তারপর উনি বললেন, 'বাহ কি সুন্দর এসেছে ছবিটা বুঝাই যাচ্ছে না আপনারা মা,মেয়ে।মনে হচ্ছে যেনো দুই বোন।'
'কি হলো খাচ্ছিস না কেনো?'
'পেট ভরে গেছে বাবা।'
'এটুকুতেই পেট ভরে গেলো?খাবার পছন্দ হয়েছিলো তো?'
'হ্যা,বাবা।অনেক মজা ছিলো খাবারটা।'
কিছুক্ষণ পর রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এলো তারা।গাড়িতে উঠলো বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে। কাননের মা রেস্টুরেন্ট থেকেই হসপিটালে চলে গেলেন।রাতে তার সার্জারী আছে।
'কি রে মা,এতো চুপচাপ বসে আছিস কেনো?'
'এমনি বাবা।মাথাটা খুব ধরেছে।'
'আয় আমার কাছে আয় আমি তোর মাথায় হাত বুলিয়ে দেই।'
কানন তার বাবার কোলে গিয়ে বাচ্চা একটি মেয়ের মতো শুয়ে পড়লো।বাবার বুকের মাঝে ফুপিয়ে উঠলো সে।
'কি রে মা,কাদছিস কেনো?'
'আমাকে তুমি এতো ভালোবাসো কেনো?'
'ভালোবাসা কি অপরাধ?'
'না বাবা। বুঝলে বাবা আমাদের জীবনে ভালোবাসা জিনিসটা হয়তো নির্দিষ্ট।ভালোবাসা যদি কেজি হিসেবে পরিমাণ করা যেতো তাহলে হয়তো এমন নিয়ম থাকতো যে কোনো মানুষের জীবনে এক কেজির বেশি ভালোবাসা থাকতে পারবে না।কারো কারো জীবনে এই এক কেজি ভালোবাসাই ভাগ করা,তার মা এক পোয়া,বাবা এক পোয়া,ভাই বোনেরা এক পোয়া এভাবে ভাগ করা। বলো তো বাবা আমার জীবনে এই বন্টনটা কেমন?'
'জানি না,মা।'
'আমার জীবনের এক কেজি ভালোবাসাই তোমার দেয়া বাবা।'একটু চোপ করে থেকে আবার বলতে লাগলো সে,'আমাকে কেউ কেনো ভালোবাসে না বাবা?'
আতকে উঠলো যেনো কাননের বাবা, মি: আরাফাত,'এসব তুই কি বলছিস মা?কে ভালোবাসে না তোকে মা?তুই চমৎকার একটা মেয়ে।সবাই তোকে ভালোবাসে।'
জোরে জোরে হেসে উঠলো কানন।
'বাবা তোমাকে একটা কথা বলবো?কথাটা অনেকদিন যাবৎই বলতে চাচ্ছি।'
'হ্যা মা, বল।'
'তোমাকে আমি প্রচন্ড ভালোবাসি বাবা।'বলেই আবারো কেঁদে ফেললো কানন।
'আমিও তোকে খুব ভালোবাসিরে মা।'মি: আরাফাতের চোখেও পানি চলে এসেছে।
'আচ্ছা মা।আমি যদি কখনো বড় কোনো অপরাধ করি তুই কি আমায় ক্ষমা করতে পারবি?'
'তুমি হলে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা।তুমি কোনো অপরাধ করতেই পারো না!'
বাসায় পৌছালো তারা এগারোটার দিকে।কাননকে তার বাবা তার রুমে রেখে গেলো।একটু পরেই ফটিক এলো তার রুমে হাতে বই পত্র নিয়ে।ঘুমে চোখ টকটকে লাল হয়ে আছে।
'কি রে ঘুমাস নি এখনো?'
'না আফা।আপনারে পড়া দেয়া লাগবো না?পড়া দিয়া তারপরে ঘুমামু।'
'আমাকে পড়া তো কালও দেয়া যাবে।'
তার মুখ দেখে মনে হলো সে অতটা খেয়ালই করে নি।সে হঠাৎ করে যেনো খেয়াল করলো কাননকে। বললো,'আপা আপনের কি হইছে?চোখ মুখ লাল কেনো?কান্না করছেন?'
'তোর চোখও তো লাল।তুই কান্না করেছিস?'
'না তো!আমার চোখ কেনো লাল হবো!'
আয়নার সামনে গিয়ে বললো 'আসলেই তো লাল!হায় হায় এ কি হইলো!'
'যা তো ফটিক এখান থেকে।তোর ঘুম পেয়েছে তাই চোখ লাল।'
'ঘুম পাইলে চোখ লাল হয় কেনো আফা?'
'জানি না ফটিক।যা এখন তুই।তোর পড়া কাল কলেজ থেকে ফিরে এসে ধরবো।'
'আপনের শরীর ভালা না।আপনের আব্বা জীবনেও আপনেরে কলেজে যাইতে দিবো না।'
সত্যিই পরদিন কাননের কলেজে যাওয়া হলো না।বাইরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে বের হওয়ার উপায় নেই একদমই।
নাস্তার পর বারান্দায় গিয়ে বসলো কানন।একটু চা হলে ভালো হতো কিন্তু উঠতে ইচ্ছে করছে না।দরজায় শব্দ হচ্ছে ক্যারক্যারে টাইপের হরর মুভি গুলোতে যেমন হয় ঠিক তেমন।বাতাসের জন্য মনে হয়।খানিক পরে দুই কাপ চা নিয়ে বারান্দায় এলো ফটিক।
'তুই কিভাবে বুঝলি আমার এখন চা প্রয়োজন? '
'আপনে যখনই একা থাকেন তখনই আপনার হাতে চায়ের কাপ থাকে আইজকা নাই।তাই আমি নিয়া আসলাম।'
'তোকে ধন্যবাদ। '
'আপা আপনের কি মন খারাপ?'
'না তো।'
'কিন্তু আমার মনটা খুবি খারাপ।'
'কেনো কি হয়েছে?'
'দেখেন না আম্মা খালি বকা ঝকা করে।এইটা করিস না ওইটা করিস না।এখন ঘুমা,এখন খেল,এখন খা।এতো শাসন ভালো লাগে?আপনের কপালটাই ভালো যহন যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন।এখন মনে হব কফি খামু আপনে গাড়ি নিয়া যাবেন কফি খাইতে আবার মনে হব খামু না।তক্ষন ফিরা আসবেন।'
খুব জোড়ে হেসে উঠলো কানন।
'আপা আপনের কি হইছে?এমন কইরা হাসেন কেন?'
'তোর কথা শুনে হাসি।'
'হাসনের মতন কি কইলাম?'
'আমার জীবন তোর ভালো লাগে?নিবি আমার জীবনটা?'
'নেয়ন গেলে ঠিকি নিতাম।তহন আপনেই দিতেন না।বলতেন 'ওই গরীব ফটিকের জীবন দিয়া আমি কি করমু?'
'আমি তোর থেকেও গরীবরে ফটিক।তোর তো তবু একটা অস্তিত্ব আছে।'
'অস্তিত্ব মানে কি আফা?'
'তোর কখনো মনে হয়েছে যে এই পৃথিবীতে তুই কোনো কারণ ছাড়াই বেঁচে আছিস?তুই বেঁচে থাকলেও কারো কিছু যায় আসে না আবার মরে গেলেও না।তোর হাসিতেও কারো কিছু যায় আসে না আবার কান্নাতেও না।'
'না তো এমন কেনো মনে হবো।'
'সে জন্যই তো তোর জীবনের দাম আমার জীবনের চেয়ে বেশি।তুই কি জানিস মাঝে মাঝে আমার খুব হিংসে হয় তোকে?'
'আমারো একটা জীবন হেইডাও আপনার হিংসা হয় কি যে কন আফা!'
'হ্যাঁ সত্যি বলছি।তুই বড় বেশি স্বাধীন। '
হেসে উঠলো ফটিক, 'এসব কি কন আফা!এক্ষন আমি বাইরে যাইতে নেই দেখবাইন আমার মায়ে কি বকাডা দেয় আমারে।আর আমি কিনা স্বাধীন! '
'জানিস ফটিক মাঝে মাঝে পরাধীনতার মাঝেও স্বাধীনতা থাকে।'
'বুঝলাম না আফা।'
'আচ্ছা বুঝাচ্ছি।ধর তোর কিছু নিয়ে প্রচন্ড মন খারাপ,জোড়ে জোড়ে কান্না করতে ইচ্ছে করছে তখন কি করবি তুই?'
'জোরে জোরে কানমু।'
'আমার যখন জোরে জোরে কান্না পায় আমি তখন কি করি জানিস?'
'কি করেন?'
'জোড়ে জোড়ে হাসি।'
'কেন আফা?কান্না পাইলে কেউ হাসে নাকি?'
'আমার কান্না করার স্বাধীনতা নেই।নিজের দুঃখ বলারও।গ স্বাধীনতা নেই।'
'আমারে বলেন আফা আপনের দুঃখ আমি শুনমু।'
'আমার কোনো দুঃখ নেই।তুই বই নিয়ে আয় তোর পড়াগুলো ধরবো এখন।'
চমৎকার পড়া বললো ফটিক।এই ছেলেটিকে দেখলেই কাননের বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে।মনে হয় জীবনে সুখ বলেও হয়তো কিছু একটা আছে।ছেলেটিকে বেঁচে থাকতেও কতো সংগ্রাম করতে হচ্ছে সেই প্রেক্ষাপটে তো কাননের জীবন অনেক সহজ।
গত কিছুদিন কানন বেশ ঘুমিয়েছে হয়তো ঔষধের প্রভাবে ঘুম আসতো কিন্ত ইদানীং আবার ঘুম হচ্ছে না ঠিক মতো।
কি সব স্বপ্ন সে দেখে তারপর ভেঙে যায় ঘুম আর সারা রাত ঘুম আসে না।আজ সে স্বপ্ন দেখলো একটি পাহাড়ের চূড়ায় সে দাঁড়িয়ে আছে সে যেনো পড়ে যাবে এক্ষুনি। চিৎকার করে সাহায্য চাইছে সে।তার মা আর রিয়াদ তার কাছেই দাড়িয়ে আছে কিন্তু তাকে সাহায্য করছে না বরং যেনো কাননের চিৎকারে তারা বিরক্ত হচ্ছে।তারপর কে যেনো ধাক্কা মেরে ফেলে দিলো তাকে পেছন থেকে আর সে চিৎকার করতে লাগলো।
এমন সময় ভেঙে গেলো তার ঘুম, বিছানায় উঠে বসলো সে, এমন ঠান্ডা ঠান্ডা দিনেও ঘেমে একাকার হয়ে গেছে সে।কোনোমতে উঠে ওয়াশরুমে গেলো হাতমুখ ধুতে।বেসিনের আয়নায় নিজেকে দেখে খুব অসহায় লাগলো তার।কতো শুকিয়ে গেছে সে, চেহারার উজ্জ্বল রং ও যেনো ম্লান হয়ে এসেছে,মুখ ভর্তি ব্রন।কোথায় সেই কানন?পরিচিত মানুষ গুলো তাকে দেখলেই সুন্দর হওয়ার টিপস দেয়।
রুমে এসে কানন ঘড়ি দেখলো তিনটা আটচল্লিশ বাজে।এক কাপ চা হলে মন্দ হতো না।কিন্তু এখন রান্না ঘরে গিয়ে চা বানানোর মতো শক্তি পাচ্ছে না সে।বড়ই দুর্বল লাগছে শরীর।মোবাইল ফোন নিয়ে বসলো সে।ফেসবুকে ভিডিও দেখেছে। স্পেসিফিক কিছু না সামনে যা আসছে তাই দেখছে।বাতাস বইছে বাইরে,বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে ঝড় আসবে মনে হচ্ছে।ছাদ থেকে ভারি কিছু একটা পড়লো বলে মনে হলো।হয়তো ছাদে ভারি কিছু ছিলো যা বাতাসে পড়ে গেছে ভাবলো কানন।কিন্ত বাইরের বাতাসের কি এতো জোর আছে ভারি কিছু ফেলে দেয়ার মতো?সামান্য পরেই ঝুমিয়ে বৃষ্টি নামলো।

দরজায় জোরে জোরে হওয়া কড়া নাড়ার শব্দে ঘুম ভাঙলো কাননের। গতকাল কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলো খেয়াল নেই তার।বিছানা থেকে উঠতেই দেয়ালে থাকা ঘড়ির দিকে তাকালো সে ছয়টা পয়ত্রিশ বাজে।এতো সকালে তাকে কে এভাবে ডাকছে?নিশ্চয়ই ফটিক হয়তো সে উদ্ভট কিছু দেখেছে আর সেটাই কাননকে দেখাবে বলে ডাকছে।সামান্য বিরক্ত হলো কানন,একেই তার ঘুম হয় না এখন একটু ঘুমিয়ে ছিলো।ডাকাডাকির আর সময় পেলো না।সিন্ধান্ত নিলো কানন যেই ডাকুক না কেনো দরজা খুলেই একচোট রাগ দেখাবে সে।
দরজা খুলতেই দেখলো ফটিক ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে।কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে কিন্তু বলতে পারছে না।কাননের হাত ধরে টেনে নিয়ে এলো সে।সিড়ির কাছে এসেই দেখলো নিচে অনেক মানুষ,তারা নিজেদের মধ্যে কানাঘুষো করছে।কাননের ষষ্ঠ ইন্দীয় হঠাৎ সচেতন হয়ে উঠলো।প্রচন্ড ভয় পাচ্ছে সে,কারণ ছাড়াই যেনো হ্রদপিন্ডটা ধড়ফড় করছে। সিড়ি দিয়ে যতই নিচে নামছে চারপাশের শব্দ ততই যেনো ম্লান হয়ে উঠছে।
সিড়িতে থাকা অবস্থাতেই সে এমন কিছু দেখতে পেলো যা দেখার কথা সে কোনোদিন কল্পনাতেও ভাবে নি।
নিচে শুইয়ে রাখা হয়েছে তার মাকে, মাথাটা রক্তাক্ত।পাশেই বসে আছে মি: আরাফাত। কেউ না বললেও বুঝলো কানন তার মা আর নেই এই পৃথিবীতে।হাটতে পারছে না সে চারপাশ যেনো অন্ধকার হয়ে আসছে।কোনো মতে তার মায়ের কাছে গিয়েই মাটিতে লুটিয়ে পড়লো সে।
চোখ মেলতেই সে নিজেকে নিজের বিছানায় আবিষ্কার করলো।এতো বাজে একটা স্বপ্ন দেখেছে সে বলার মতো না!
তার কানে এলো কেউ তাকে ডাকছে,'কানন উঠ।তোর মাকে নিয়ে যাচ্ছে।শেষবার দেখবি না?'
কানন বুঝলো এসব কিছুই স্বপ্ন না বরং বাস্তব। তার ঘর ভর্তি মানুষ সবাই তাকিয়ে আছে তারই দিকে।ধীরে ধীরে উঠে নিচে গেলো সে। খাটিয়াতে শুইয়ে রাখা হয়েছে তার মাকে,সাদা কাপড়ে মুড়িয়ে রাখা হয়েছে। কানন কাছে যেতেই মুখের কাছের কাপড় সরিয়ে দিলো একজন।তার মাকে দেখতে কি অপূর্ব সুন্দর লাগছে!
তার বাবাসহ আরো কিছু ছেলে মানুষ খাটিয়া তুলে নিয়ে চলে যাচ্ছে।এতোক্ষণে যেনো বুঝলো সে কি হচ্ছে।চিৎকার করে উঠলো কানন,দৌড়ে যেতে চাইলো তাদের পেছন পেছন।কিছু মহিলা জড়িয়ে ধরে ফেললো তাকে আর বললো,'মেয়ে মানুষ তো জানাজার নামায পড়ে না।'
প্রত্যেক নিয়ম সৃষ্টির পেছনেই কিছু কারণ থাকে,এ নিয়ম সৃষ্টির কি কারণ?মানুষ কঠোর পরিশ্রম করে তার সন্তান সন্ততির সুন্দর জীবন সৃষ্টির জন্য আর সেই সন্তান সেই বাবা,মায়ের শেষ কাজটুকুতে হাত লাগাতে পারবে না।তার কারণ সে কন্যা সন্তান। মেয়ে হওয়া কি কোনো অপরাধ? এ জন্যই কি যাদের অন্তত পক্ষে একটি ছেলে সন্তান থাকে না তারা নিজেদের পৃথিবীর অন্যতম দূর্ভাগ্যবান মনে করে?
হে ধরা কেনো তুমি এতো কঠোর!কিসের এসব নিয়ম তোমার!তুমিই সৃষ্টি করেছো আমাকে এরূপে আবার তুমিই করছো অবহেলা!
কাননের আন্টি কাননকে সাথে নিয়ে ছাদে এলো।
তাদের তিনতলা বাড়ির ছাদ থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে যেখানে জানাজা পড়ানো হচ্ছে সেই জায়গাটা।চারপাশে কান্নার রোল পড়েছে যেনো।কিন্তু তার কান্না পাচ্ছে না,মাথাটা যেনো স্তব্ধ হয়ে আছে,সে কিছুই ভাবতে পারছে না।মানুষ ক্রমেই বাড়ছে নামাজে,সেই জায়গা থেকে চোখ ফিরিয়ে অন্য দিকে তাকালো সে। খানিক দূরে বেশ কিছু বাচ্চা খেলছে।জানাজা নামায শুরু হতেই অপরিচিত এক বৃদ্ধা মহিলা এসে বললো,'মেয়ে মানুষের জানাজার নামাজ দেখোন লাগে না।যাও তোমরা ভিতরে যাও।'
ভিতরে চলে গেলো তারা।
দুইদিন হয়ে গেলো।বাসা পুরো ফাকা,খুব একা লাগছে তার।একা লাগছে কেনো কাননের?এমন তো নয় যে যখন তার মা বেচে ছিলো সে সবসময় তার সাথেই থাকতো।সে তো আগে থেকেই একা থাকতো তাহলে কেনো এমন হচ্ছে?বার বার মনে হচ্ছে একটিবার যদি মাকে সে জড়িয়ে ধরতে পারতো!মায়ের গায়ের সেই গন্ধ বুক ভরে নিয়ে রাখতো সে যাতে সারাজীবন বাচতে পারে সেই গন্ধটুকু নিয়ে।
দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ পেলো সে।এখন দিন তবুও দরজা,জানালা লাগানো তার রুমের এমনকি পর্দাও টানানো,পুরো অন্ধকার হয়ে আছে ঘরটা। আবারো কড়া নাড়ছে কেউ এবার আরো জোরে।দরজা না খুললে যাবে না আগন্তুক বুঝলো কানন।দরজা খুলতেই ঘরে ঢুকলো তার মামা,মিঃ জুবায়েদ।ভদ্রলোক কাননকে খুব একটা পছন্দ করে না জানে সেটা কানন।তার ধারণা তার বোনের জীবনের সব দুঃখের কারনই কানন।কিন্তু কাননের সাথে দেখা হলে মা ছাড়া কথাই বলে না।অনেকরকম প্রশ্নই করলেন উনি।তারমধ্যে কিছু প্রশ্ন শুনে মনে হলো কাননের মায়ের মৃত্যুটা নেহাত আত্মহত্যা হিসেবে মেনে নিতে পারেন নি তিনি।কাননের নিজেরও বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে তার মা আত্মহত্যা করতে পারে কিন্তু এ ছাড়া আর কি হতে পারে?কেউ কি খুন করেছে তার মাকে?কিন্তু কে করবে খুন আর কেনই বা করবে?
তার মা মারা গেছে কিন্তু তার প্রেমিককে একটিবারের জন্যও দেখা যায় নি।শুধুমাত্র এই কারণেই কি কাউকে সন্দেহ করা যায়?
পরের দিনই এক পুলিশ অফিসার এলো তার মায়ের মৃত্যু নিয়ে তদন্ত করতে।কাননের মামাই তদন্তের জন্য নিয়োগ করেছে পুলিশ।কাননের মামা, মিঃ জুবায়ের খুবই ক্ষমতাধর ব্যাক্তি।
এদিকে দিন দিন কানন অসুস্থ হয়ে পড়ছে।যে মায়ের সাথে তার প্রতিদিন দেখাও হতো না তার শুকে সে প্রায় আধমরা। সামনে তার এইচ এস সি পরিক্ষা,কিন্তু তার এসব নিয়ে কোনো মাথা ব্যাথাই নেই।এই বাড়িতে সে আর থাকতে পারছে না।এখন সে রাতে একদম ঘুমাতে পারে না। ঘুমাতে ভয় পায় সে,ঘুমালেই তার মাকে স্বপ্ন দেখে।সেই স্বপ্নগুলো কখনো কখনো খুবই সুন্দর হয় কিন্তু অধিকাংশ স্বপ্নই হয় ভয়ংকর। প্রত্যেকটা স্বপ্নেই সে বুঝতে পারে তার মা বেচে নেই তবুও সে তাকে দেখছে।
তার বাবা বুঝতে পারছে এসবই, তাই তো সে কাননকে লন্ডন পাঠানোর ব্যবস্থা করছে পড়াশোনার জন্য। শুরুতে কাননের একা যাওয়ার ব্যবস্থাই করছিলেন তারপর তিনি বুঝলেন কাননের যে অবস্থা সে একা একা সারভাইভ করতে পারবে না লন্ডন। তাই অনেক ভেবে চিনতে সে সিন্ধান্ত নিয়েছে সেও তার ব্যবসা বাণিজ্য গুটিয়ে লন্ডনে চলে যাবে।তার বাবা তাকে কেনো এতো ভালোবাসে?
তার বাবাও ভালো নেই বুঝে সে সেটা।তার মা মারা গেছে এখনো এক সপ্তাহও হয় নি কিন্তু তার বাবার মুখের দিকে তাকানোও যায় না সে প্রায় শেষ।
রাত একটা বাজে ঘুমের ঔষধ খেয়েছে সে কিন্তু তবুও ঘুম আসছে না।রুমের ভিতরেই হাটছে সে।হাটতে হাটতে রুম থেকে বেরিয়ে তার মায়ের রুমে গেলো সে।রুমে ঢুকতেই কিছু একটার অনুপস্থিতি অনুভব করলো সে।কিন্তু সেটা কি?তারপরেই বুঝলো তার মায়ের রুমে সব সময়ই এয়ার ফ্রেশনার দেয়া থাকতো আগে কিন্তু আজ সেটা দেয়া নেই।ওই গন্ধটাকে তার মস্তিষ্ক তার মায়েরই একটা অংশ হিসেবে মেনে নিয়েছে।কারণ এই এয়ারফ্রেশনারটার গন্ধ তার মা ছাড়া আর কারো রুমে পায় নি সে কখনো।
কানন এয়ারফ্রেশনারটা খুজতে লাগলো সে এই গন্ধটা পেতে চায় আবারো।অনেক খুজেও পেলো না সে।অদ্ভুত কোথায় যাবে?কেউ তো এ রুমে আসার কথা না!
নিজের রুমে ফিরে এলো সে।শুয়ে পড়লো বিছানায় এখনো ঘুম আসছে না।বার বার মনে হচ্ছে তার মা যখন ছাদ থেকে লাফ দিলো তখনো সে জেগেই ছিলো সে যদি একবার বাইরে গিয়ে দেখতো কি পড়েছিলো সেই রাতে ছাদ থেকে হয়তো তার মা আজ বেচে থাকতো।হয়তো তাকে বাচানো সম্ভব হতো।এসব ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়লো সে।গতানুগতিকভাবে ঘুমানোর একটু পরেই স্বপ্ন দেখলো সে।সে তাদের বাগানে দাঁড়িয়ে আছে, তার মা ছাদ থেকে পড়ে যাচ্ছে,চিৎকার করছে,বলছে,'কানন বাচা আমাকে।'কিন্তু কানন নির্বিকারভাবে দাঁড়িয়ে আছে।দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে সব।স্বপ্নে তার মায়ের শরীর মাটিতে পড়তেই তার ঘুম ভেঙে গেলো।সারাশরীর ভিজে আছে ঘামে। ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্না শুরু করলো সে।তার কানে এখনো বাজছে,'কানন বাচা আমাকে!'
তারপর হঠাৎ করেই কান্না থামালো সে।কাননের মা যে রাতে আত্মহত্যা করেছিলো সে রাতে কানন তার মায়ের বডি মাটিতে পড়ার শব্দ পেয়েছিলো কারণ কানন নিচতলায় থাকে।কিন্তু কোনো চিৎকার তো শুনতে পায় নি।এটা কিভাবে সম্ভব একজন মানুষ এতো উপর থেকে
পরে মারা গেছে অথচ সামান্য চিৎকার করে নি?
একমাস পরের কথা আগামীকাল কানন আর তার বাবার লন্ডনে যাওয়ার ফ্লাইট। একসপ্তাহ আগে তার বাবাকে এরেস্ট করা হয়েছে তার মাকে হত্যা করার অপরাধে। আজ কোর্টে হেয়ারিং আছে।কানন জানে আজ তার বাবা নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে ফিরে আসবে।খুব সুন্দর করে আজ সাজছে সে।কি চমৎকার লাগছে তাকে!
ফটিক বললো,' আপনার আব্বা আপানেরে এমনে দেইখা খুবই খুশি হবো।একটা ফুলের মালা কিনা নিয়া যান।স্যার দেখবেন আইজকা নির্দোষ প্রমাণ হবোই।'
'আমি কোর্টে যাচ্ছি না ফটিক।তাইলে কই যান?'
'ঘুরতে যাচ্ছি।'
'কোনে আর কার লগে?'
'কোথায় যাবো জানি না আর কারো সাথে ঘুরতে যাবো না একা একাই ঘুরতে যাবো।'
'কি কন আফা এগলা?একলা কেউ ঘুরে?'
'কেনো ঘুরে না?তুই জানিস তুই যখন একা থাকা শিখে যাবি সব কিছু একাই করতে শিখবি তারচেয়ে পিসফুল আর শক্তিশালী এই পৃথিবীতে আর কিছু নেই?'
'না আফা এই সময় একলা যাইয়েন না কোথাও।আমি যাই আপনের সাথে?'
'না।'
'আপা আপনের ফুপুরে নিয়া যান তাইলে।একা একা ঘুরতে ভাল্লাগবে না।'
'একজন মানুষ কখনো নিজে নিজেই একাকীত্ব বেছে নেয় না।সে শুরুতে মানুষের সংগ চায়,নিজের দুঃখের কথা বলতে চায় কাউকে।কিন্তু পরিশেষে কাউকে না পেয়ে নিজের জন্য বেঁচে থাকার একটা পথ খুজে বের করে।আর সেই পথের নামই একাকীত্ব। কিছু মানুষ একসময় সেই একাকীত্বও উপভোগ করা শুরু করে।আর সেই মানুষগুলোর মধ্যে আমি একজন।আমার এখন একা থাকতে,ঘুরতেই ভালো লাগে।'
'কিন্তু আপনের আম্মা মারা গেলো এক মাসো হয় না,আপনের আব্বা এহনো জেলে এমন সময় আপনে ঘুরতে যাবেন।মানুষ কি বলবো? '
'আচ্ছা ফটিক তুই জানিস গত একটা বছর যাবৎ আমি কি অসুস্থ। ঘর থেকে বের হই না,কত রাত গেছে না ঘুমিয়ে,কত বেলা না খেয়ে কাটিয়েছি।এই বলার মানুষগুলো তখন কোথায় ছিলো?কেউ তো আমার পাশে এসে দাড়িয়ে বলে নি,'কি হয়েছে তোমার কানন?তুমি কষ্ট পেয়ো না।আমি তোমার পাশে আছি।'আসলে কারো কিছু যায় আসেই না অন্যের জীবন নিয়ে।মানুষ শুধু পারে অন্যকে নিয়ে ক্রিটিসিজম করতে।আমার প্রশ্ন হচ্ছে যে মানুষগুলো আমার দুঃখের সময় আমার পাশে ছিলো না আজ আমি কেনো তাদের কথা গায়ে মাখবো?
শুধু আজ কেনো কোনো দিনই তাদের কথা আমি গায়ে মাখবো না।আমাকে ভালো রাখার দায়িত্ব শুধুই আমার। এই পৃথিবী বসে নেই আমাকে খুশি করার জন্য,বরং সুযোগ বুঝে কষ্ট দিতে সদা প্রস্তুত।আর তাই যেভাবেই হোক না কেনো আমি নিজেকে খুশি রাখবো।কারো কথায় আমার কিছুই যায় আসে না। '
এসব বলে বেরিয়ে গেলো সে।আজ আর গাড়ি নিয়ে বেরোলো না।পায়ে হেটেই ঘুরবে সে,সে কোনো খুনির সম্পত্তি দিয়ে বিলাসিতা করতে চায় না।
আজ হয়তো তার বাবা দুনিয়ার দৃষ্টিতে নির্দোষ হয়ে ঘরে ফিরে আসবে,কিন্তু কানন জানে তার বাবা একজন কোল্ডব্লাডেড মার্ডারার,সেই খুন করেছে তার মাকে।তার বাবা,মা মিলে আজ তাদের এই সম্পত্তির প্রাচূর্য তৈরি করেছিলো।সম্পত্তির অর্ধেক মালিক তাই তার মা।খুব শীঘ্রই তার বাবা,মায়ের ডিভোর্স হয়ে যেতো আর এই বিশাল সম্পত্তি হাত ছাড়া হয়ে যেতো তার বাবার।কি অদ্ভুত! কাননের বাবা তো ভালোবাসতো তার মাকে!পৃথিবীর সব ভালোবাসাই কি এমন?
কানন নিজে গিয়ে খোঁজ নিয়েছিলো,কাননের বাবা একটি নির্দিষ্ট ফর্মুলা দিয়ে স্পেশালভাবে দুইটি এয়ারফ্রেশনার বানিয়েছিলো। আর সেই ফর্মুলাটাই সে খুজে পেয়েছিলো।এই ফর্মুলাটা সে মেইল করেছিলো বিদেশি এক সায়েন্টিস্টকে সে বলেছে এটা একটা মারাত্মক এয়ারফ্রেশনারের ফর্মুলা এখানে হাইড্রোজেন সায়ানাইড ব্যবহার করা হয়েছে।এই হাইড্রোজেন সায়ানাইডের হাল্কা বাদামের মতো গন্ধ সে তার মায়ের রুমে গেলে পেতো।নিয়মিত কেউ এটা ব্যবহার করলে ধীরে ধীরে তার হার্ট,ফুসফুস, ব্রেইন সবই এফেক্টেড হবে।ধীরে ধীরে সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে।
কাননের ধারণা তার মা বুঝে ফেলেছিলো এইসব,আর তাই তাকে সরাতে তার বাবাই তার মাকে ছাদ থেকে ফেলে দিয়েছে।
তার মাকে খুন করেছে তার নিজের বাবা।নিজের বাবা কেনো বলছে কানন?বরং বলা উচিত পালিত বাবা।সে এই রহস্যও জানে যা তার পালিত বাবা,মা এতো বছর থেকে লুকিয়ে রেখেছিলো তার থেকে।তাদের হসপিটালেই তার নিজের বাবা,মা ফেলে চলে যায় তাকে।তখন তার পালিত বাবা নিজের বাড়িতে নিয়ে আসে কাননকে কারণ তার অসুস্থতার জন্যই তার স্ত্রী মা হতে পারছিলেন না।কাননের বাবা তাকে নিজের মেয়ে হিসেবে মেনে নিতে পারলেও কাননের মা মানতে পারেন নি।তিনি সবসময়ই নিজের সন্তান চেয়েছেন আর তাই শেষ পর্যন্ত ডিভোর্স দিতে চেয়েছিলেন তার স্বামীকে।
তার নিজের বাবা,মায়ের কাছে সে এতোটাই বেশি ছিলো?তার ভার তার মা,বাবা বহন করতে পারলো না?
# কানন একটি পার্কে এসে পৌছালো,পার্কে মানুষ তেমন নেই।আকাশ মেঘলা হয়ে এসেছে বৃষ্টি আসবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। পার্কটার সামনে বিশাল নদী পার্ক থেকে সিড়ি বেয়ে নামতে হয় সেই নদীতে সিড়ির চারপাশে কাশফুল ফোটে আছে।কি সুন্দর লাগছে।কানন সিড়ি বেয়ে নিচে নামলো।সিড়িতে বসে নদীতে পা ভিজিয়ে বসে রইলো। তার খুব ভালো লাগছে আজকে।এই পৃথিবীতে আর এমন কেউ নেই যে কাননকে আর কষ্ট দিতে পারে।কোনো কষ্টই আর তার কাছে কষ্টই মনে হবে না।কারণ সে অনেক বড় বড় কষ্ট পেয়েও আজ বেচে আছে।এতো দিন নিজের উপর খুব রাগ হতো কাননের যে সে এই জীবনে কিছুই অর্জন করতে পারে নি।কিন্তু আজ মনে হচ্ছে সে অনেক বড় কিছুই অর্জন করেছে এই যে সে বেচে আছে এর চেয়ে বড় অর্জন আর কি হতে পারে?
অনেকদিন হলো কানন কান্না করে না।আজ একটু কান্না করলে কেমন হয়?
কিছুক্ষণের মধ্যেই অঝোরে বৃষ্টি নামলো,পার্ক একদম খালি হয়ে গেলো।পার্কে কেউ থাকলেও হয়তো কোনটা কাননের চোখের পানি আর কোনটা বৃষ্টির পানি তার তফাৎ করতে পারতো না।তফাৎ করতে পারতো না কোনটা কাননের করা চিৎকার আর কোনটা মেঘের গর্জন।